এস.এম.পিন্টু: বাংলাদেশ রেলওয়ের অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের দক্ষতায় রেলের একটি প্রকল্প থেকেই ৬৬৯৮ কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার (প্রায় ৭ হাজার কোটি) টাকা সাশ্রয় হয়েছে বলে জানা গেছে। দোহাজারী কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প থেকে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার বিশাল এই অর্থ সাশ্রয় হয়েছে বলে বিশ্বস্ত একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

প্রকল্প সুত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধনের জন্য উপস্থাপন করা হয়। সংশোধনী প্রস্তাবের উপর আলোচনা শেষে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি)। ১ম সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তন্মধ্যে দোহাজারী-কক্সবাজার অংশের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি ৩৫ লাখ ৯৩ হাজার টাকা এবং রামু-ঘুমধুম অংশের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ২ হাজার ৫৫৮ কোটি ১১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা।

সুত্রটি আরো জানান, রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭২ কিলোমিটার রেলপথ ও উখিয়া এবং বান্দরবানের ঘুনধুমে দু’টি স্টেশনও নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। উদ্দেশ্য ছিল ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে রুট-১-এ সংযুক্ত হওয়া। এ অংশে অর্থায়নের জন্য উন্নয়ন সহযোগি না পাওয়ায় অনুমোদিত ২য় সংশোধিত ডিপিপিতে ঐ অংশের কাজ প্রকল্পের হতে বাদ দেওয় হয়। এতে করে প্রকল্পের ২ হাজার ৫৫৮ কোটি ১১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা হ্রাস করা হয়।

অন্যদিকে দোহাজারী-কক্সবাজার অংশে পুনর্বাসন এবং ভূমি অধিগ্রহণ খাতে ১ম সংশোধিত ডিপিপি’র তুলনায় ২য় সংশোধিত ডিপিপি’তে প্রায় ৭০৯ কোটি ৭৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকা সাশ্রয় হবে, পূর্ত প্যাকেজে সাশ্রয় হবে প্রায় ১৯০২ কোটি ২১ লাখ ১ হাজার টাকা, সিডি-ভ্যাট বাবদ সাশ্রয় ৪৮৪ কোটি ৭ লাখ ৬১ হাজার টাকা, পরামর্শক সেবা খাতে ৪৬ কোটি ৮৬ লাখ ৭৭ হাজার টাকা, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট খাতে ১৮ কোটি ৯৬ লাখ ১৫ হাজার টাকা, কন্টিজেন্সি খাতে ৯৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা সাশ্রয়ের বিষয়টি অনুমোদিত হয়েছে। অর্থাৎ দোহাজারী-কক্সবাজার অংশে ১ম সংশোধিত ডিপিপি’র তুলনায় অনুমোদিত ২য় সংশোধিত ডিপিপি’তে প্রায় ৪১৪০ কোটি ৩৮ লাখ ৯৩ হাজার টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে। সর্বোপরি দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ১ম সংশোধিত ডিপিপি’র তুলনায় অনুমোদিত ২য় সংশোধিত ডিপিপি’তে প্রায় ৬৬৯৮ কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার টাকা কম ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

রেলওয়ের সূত্রটি জানায়, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের জেলা পর্যটন শহর কক্সবাজারকে রেলে যুক্ত করার পরিকল্পনা হাতে নেয় তৎকালীন হাসিনা সরকার। ফলে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার হয়ে ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে প্রকল্প গ্রহণ করে। মাত্র ১৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১০ সালে একনেকে অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। ২০১৩ সালে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও পর্যাপ্ত তহবিল সংকট ও ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় তখন আর কাজ শুরু করতে পারেনি। সেই একই প্রকল্প ২০১৪ সালে নকশা পরিবর্তন করে ডুয়েল গেজ হওয়ার ফলে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। যা সরকারের ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্প হিসেবে গৃহিত হয়। প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে সে সময়ে তীব্র সমালোচনা হলেও তাতে কর্ণপাত করেনি সংশ্লিষ্টরা। কাজে নানা অনিয়মের বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও সেবিষয়ে ভ্রুক্ষেপ ছিলনা কর্তৃপক্ষের। পরে প্রকল্পের কাজ শেষ না করেই তরিঘরি করে ২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর রেললাইন উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এ ব্যপারে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলেল মহ্ব্যবস্থাপক (জিএম) মো. সুবক্তগীন বলেন, ”সরকারের সদিচ্ছা ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বিচক্ষণতায় রেলের প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। এটা সরকারের একটা বড় অর্জন। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলেই এটি সম্ভব হয়েছে।”

উল্লেখ্য, ১১৩৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রায় ১০১ কিলোমিটার ডুয়েলগ্যাজ রেলপথ নির্মাণ ছাড়াও প্রায় ১৩৬৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দের পাড়াতে ২৯ একর জমিতে নির্মিত হয়েছে ১ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুটের দৃষ্টিনন্দন ছয়তলা ভবনের আইকনিক রেলস্টেশন। যেখানে আছে সুবিশাল পার্কিং, তারকা মানের হোটেল, শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, শিশুযত্ন কেন্দ্র, পোস্ট অফিস, কনভেনশন সেন্টার, ইনফরমেশন বুথ, এটিএম বুথ, প্রার্থনার স্থান, লাগেজ রাখার লকারসহ অত্যাধুনিক সব সুবিধা।

এই প্রকল্পের আওতায় মোট ৯টি স্টেশন রয়েছে। স্টেশনগুলো হলো- দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগারা, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু, ও কক্সবাজার।

এছাড়াও রেল কর্মচারি ও নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য আবাসিক ভবন এবং অত্যাধুনিক রেস্ট হাউজ। হাতির নিরাপদ চলাফেরার জন্য ১ টি ওভার পাস ও ২টি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়েছে।

চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড জেভিতে দুই ভাগে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করছে।

২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল। শুরু হয় এটি সরকারের অগ্রাধিকার (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে শুধু আইকনিক রেলস্টেশন নির্মাণের বিপরীতে খরচ হয়েছে ২১৫ কোটি টাকা।

শেয়ার করুন...

সাম্প্রতিক খবর